বাংলাদেশ থেকে এই মূহুর্তে বিদেশে রপ্তানি করা মংস্য সম্পদের মধ্যে চিংড়ির পরই সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনাময় পণ্য হচ্ছে কাঁকড়া। এর মধ্যে কাঁকড়ার শক্ত খোলসের মধ্যে নরম খোসার কাঁকড়া, যাকে সফটশেল কাঁকড়া বলে তার চাহিদা বিদেশে বাড়ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মিঠা ও লবণাক্ত পানি মিলে মোট ১৫ প্রজাতির কাঁকড়া রয়েছে। তবে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয় ম্যাডক্র্যাব বা শিলা কাঁকড়া। এটির ওজন সর্বোচ্চ সাড়ে তিন কেজি পর্যন্ত হতে পারে।
বাংলাদেশে উৎপাদিত এই শিলা কাঁকড়া তার জীবদ্দশায় ১৪-১৬ বার খোলস বদল করে থাকে। খোলস বদল করার সময় তিন ঘণ্টার বেশি সময় এটির দেহ খোলসহীন অবস্থায় পাতলা আবরণ দিয়ে ঢাকা থাকে। তখন এটিকে রপ্তানীর জন্য তুলে ফেলা হয়। নরম এই কাঁকড়াকেই বলা হয় ‘সফটশেল’ কাঁকড়া।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আনিছুর রহমান বলেন, ‘সফটশেল’ কাঁকড়া চাষের ক্ষেত্রে কয়েক ঘণ্টা পরপরই দেখতে হয় যে কাঁকড়া খোলস পাল্টেছে কিনা। তাই এই কাঁকড়া চাষের সাথে সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও এর আশপাশের অনেক নারী জড়িত। তাদের শ্রম পুরুষদের তুলনায় সস্তা হওয়ার কারণে এই শিল্পে তাদের অংশগ্রহণ বেশি।
বাংলাদেশে যেসব জেলায় সফটশেল কাঁকড়া উৎপাদিত হয় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সাতক্ষীরা জেলা। এই জেলার মৎস্য কর্মকর্তা আনিছুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, জুন-অগাস্ট মাসে বিশেষ করে সফটশেল কাঁকড়ার চাহিদা বিদেশে বেশি থাকে।
“সফটশেল কাঁকড়া যেটা এটারই বেশি চাহিদা এখন। বছরে এটাই প্রায় দুই হাজার মেট্রিক টনের মতো উৎপাদিত হয়,” বলেছেন মি. রহমান। “এমনকি কাঁকড়া যেটা হার্ড থাকে সেটা খাওয়াটা বেশ কষ্টকর। আর এটার যেহেতু শেল থাকে না, সফট হয়ে যায় পুরো বডিটা, তাই যেকোন বয়সের মানুষ এটা খেতে পারে,” বলেন তিনি।
খুলনা বিভাগীয় মৎস্য পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ দপ্তরের কর্মকর্তা লিপ্টন সর্দার বিবিসি বাংলাকে বলেন, সফটশেল কাঁকড়ার রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে দেশ থেকে প্রায় ৩৫ মিলিয়ন ডলারের কাঁকড়া রপ্তানি করা হয়েছিল। এর মধ্যে শক্ত খোলসের কাঁকড়াও রয়েছে।
শক্ত খোলসের কাঁকড়ার প্রধান বাজার চীন। সেখানে এই কাঁকড়া জীবন্ত রপ্তানি করা হয়। গত চার বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের সফটশেল কাঁকড়ার রপ্তানি উর্ধ্বমুখী রয়েছে।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে শুধু খুলনা অঞ্চল থেকে ৬২২ মেট্রিকটন সফটশেল কাঁকড়া রপ্তানি করা হয়েছে। এ খাতে আয় হয়েছে ৮৬ লাখ ৯৮৮মার্কিন ডলার।
মূলত যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, ইউরোপিয় ইউনিয়নভূক্ত কয়েকটি দেশ এবং সিঙ্গাপুরে সফটশেষ কাঁকড়া রপ্তানি করা হয়। মৎস্যখাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই খাতকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হলে এবং এ খাতের সমস্যাগুলো সমাধান করা গেলে কাঁকড়া রপ্তানি থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হবে।
পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে আড়াই থেকে তিন লাখ মানুষ কাঁকড়া চাষ ও বাজারজাতকরণের সাথে যুক্ত আছেন। সাতক্ষীরা জেলার মৎস অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, শুধু এই জেলাটিতেই ৩০ হাজার মানুষ কাঁকড়া চাষের সাথে জড়িত।
‘সফটশেল’ কাঁকড়ার কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:
বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে দেশ থেকে প্রায় ৩৫ মিলিয়ন ডলারের কাঁকড়া রপ্তানি করা হয়েছিল। এর মধ্যে শক্ত খোলসের কাঁকড়াও রয়েছে।
শক্ত খোলসের কাঁকড়ার প্রধান বাজার চীন। সেখানে এই কাঁকড়া জীবন্ত রপ্তানি করা হয়।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মথুরাপুর গ্রামের বাসিন্দা তাপস কুমার মন্ডল শ্যামনগরের হরিনগর এলাকা থেকে কাঁকড়া ঢাকায় পাঠান। তিনি স্থানীয় ডিলারদের কাছেই কাঁকড়া বিক্রি করেন।
প্রতিদিন ৪০-৫০ কেজির মতো কাঁকড়া সংগ্রহ করেন তিনি। তবে যেদিন কাঁকড়ার দাম বেশি থাকে সেদিন বেশি পরিমাণে পাঠানোর চেষ্টা করেন।
তার নিজের কাঁকড়ার ঘের রয়েছে। সেখানে কাঁকড়া মোটাতাজা করা হয়।
কাঁকড়ার দাম সম্পর্কে মি. মন্ডল বলেন, কাঁকড়ার ওজন অনুযায়ী গ্রেড ও দাম ঠিক করা হয়। ওজন যত বেশি, দামও তত বেশি।
পুরুষ কাঁকড়া ৫০০ গ্রাম ওজনের হলে ১৪০০ টাকা করে কেজি বিক্রি হয়। আর স্ত্রী কাঁকড়া ২০০ গ্রাম ওজনের হলেই সেটি ১৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা যায়।
এর চেয়ে কম ওজনের কাঁকড়া গড়ে ৮০০-৯০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয় বলেও তিনি জানান।
তবে এই দাম ওঠানামা করে বলেও জানান তিনি। সবচেয়ে কম দামে বিক্রি হয় ‘রিজেক্ট’ কাঁকড়া। অর্থাৎ যেগুলোর ওজন কম, হাত-পা ভেঙ্গে গেছে ইত্যাদি।


