অর্থনীতিতে চামড়া শিল্প খাতের প্রভাব

চামড়া বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত। কিন্তু বাস্তবে সিদ্ধান্তহীনতা এবং দুর্নীতির শিকার হয়ে গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরেই এই খাত পতনশীল! পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল পাট। পাট ও পাটজাত পণ্যই ছিল পাকিস্তানের প্রধান রপ্তানি পণ্য। দেশের জাতীয় আয়ের ৬৫ শতাংশই আসত কৃষি খাত থেকে। দেশীয় ব্যবহার ও রপ্তানিতে চা ও চামড়ার উপস্থিতি এবং অবস্থান ক্রমে বাড়তে থাকে। এ দেশ মুসলিম অধ্যুষিত হওয়ায় পবিত্র ঈদুল আজহার সময় প্রচুর গরু, ছাগল প্রভৃতি পশু কোরবানি হয়। এছাড়া সারা বছরই এসব পশুর মাংস ক্রয়-বিক্রয় হয়ে থাকে। ফলে চামড়ার উৎপাদন ও সরবরাহ বাংলাদেশে বহুপূর্ব থেকে ক্রমে বাড়ছে। ব্যবসা হিসেবে এ দেশে চামড়া খাতের যাত্রা শুরু হয়েছে গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে।

প্রথমবারের মতো দেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি আয় এক বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) এ খাতে রপ্তানি হয়েছে ১১১ কোটি ৫৫ লাখ ডলার। চলতি অর্থবছরে চামড়া খাত থেকে এতটা রপ্তানি আয় হবে সেটা অবশ্য বছরের শুরুতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে অকল্পনীয় ছিলো। যেহেতু, পুরো অর্থবছরে এ খাত থেকে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ১০৩ কোটি ডলার। এগারো মাসেই এ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে সাড়ে আট কোটি ডলার বেশি রপ্তানি আয় এসেছে। তথ্যে আরো বলছে, জুলাই থেকে মে পর্যন্ত সময়ে এ খাতে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি আয় এসেছে ফুটওয়্যার বা পাদুকা থেকে। মোট ৬৭ কোটি ৩০ লাখ ডলারের রপ্তানি আয় এসেছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৩১ দশমিক ৫৯ শতাংশ বেশি।

বাংলাদেশের চামড়া শিল্পের বিকাশে এলডব্লিউজির সনদ অর্জনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বিসিক ও ট্যানারি মালিকদের মধ্যে সমন্বয় বজায় রেখে কাজ করে যাওয়া একান্ত প্রয়োজন। সক্ষম ট্যানারিগুলোর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ইটিপি নির্মাণ করার অনুমতি প্রদান করা যেতে পারে। এতে, সিইটিপি’র ওপর চাপ কমবে এবং সক্ষম ট্যানারিগুলো ধীরে ধীরে মানসম্মত হওয়ার সুযোগ পাবে। তাছাড়া, শিল্পনগরীর মালিকদের অংশে কোন কোন কারখানার কী কী পরিবেশগত মান বজায় রাখা প্রয়োজন সে বিষয়ে মালিকদের একটি চেকলিস্ট প্রদানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে, মালিকরাও তাদের করণীয় সম্পর্কে অধিকতর সচেতন হতে পারবেন।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, গত ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম এগারো মাসে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে ৮৪ কোটি ৬০ লাখ ডলার রপ্তানি হয়। সেই হিসাব মতে, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এ বছর চামড়া খাতে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩১ দশমিক ৮৫ শতাংশ। এবং সংশ্নিষ্টরা বলছেন, ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশে করোনার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে নানা ধরনের প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ওইসব দেশে চামড়াজাত পণ্যের বিক্রি ভালো। তাছাড়া, পর্যটন স্পটগুলো খুলে দেওয়ার পর থেকে ভ্রমণের প্রয়োজনে নতুন করে চাহিদা বেড়েছে জুতা, ব্যাগ ইত্যাদির। এমতাবস্থায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে দেশে দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় আগামীতে এ ধরনের পণ্যের চাহিদা কমার আশঙ্কা রয়েছে।

সর্বোপরি, বাংলাদেশে কাঁচা চামড়ার বার্ষিক চাহিদার প্রায় শতকরা ৪৫ ভাগ আসে কোরবানির পশু থেকে। এই কোরবানির ঈদে সঠিক ব্যবস্থাপনা, বাজার মনিটরিং, দ্রæত সংরক্ষণ, পরিবহন এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে এ খাতের বিভিন্ন স্তরে ব্যবসায়ীরা যাতে লাভবান হতে পারেন এবং উন্নতমানের চামড়া প্রস্তুত করার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। শুধু চামড়া উৎপাদন নয়, বহুমুখী চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনে উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে। দেশের অর্থনৈতিক অগগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হলে সম্ভাবনাময় চামড়া খাত উন্নয়নে ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *